বাংলাদেশ

বেনজীরকে দুদকে তলব স্ত্রী-সন্তানের নামে ৬২১ বিঘা জমি

By

on

Feb 22, 2024

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদকে স্ত্রী-সন্তানসহ তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো নোটিশে বেনজীর আহমেদকে আগামী ৬ই জুন, তার স্ত্রী ও সন্তানদের ৯ই জুন হাজির হয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। দুদক সূত্র জানিয়েছে, সাবেক আইজিপি বেনজীর তার আয়কর ফাইলে যে সম্পদ দেখিয়েছেন, সেসব সম্পদের বৈধ উৎস, উপার্জনের বৈধ খাত খতিয়ে দেখবে দুদক। এছাড়া, বেনজীরের স্ত্রী এবং সন্তানদের আয়ের খাত হিসাবে দেখিয়েছেন ব্যবসা। খতিয়ে দেখা হবে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

 এদিকে আদালতে জমা দেয়া দুদকের নথি থেকে জানা যায়, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর, স্ত্রী ও সন্তানদের মালিকানায় ৬২১ বিঘা জমির সন্ধান মিলেছে এ পর্যন্ত। দুদকের অনুসন্ধান এখনও চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী জীশান মির্জা। তার নামে প্রায় ৫২১ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুদক। বাকি ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে বেনজীর, তার তিন মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীর ও জারা জেরিন বিনতে বেনজীর এবং স্বজন আবু সাঈদ মো. খালেদের নামে।

দুই দফায় আদালত তাদের নামে থাকা ৬২১ বিঘা জমি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন।

আইনবিদদের মতে, ১৯৮৪ সালের ল্যান্ড রিফর্মস অর্ডিন্যান্স রহিত করে ভূমি সংস্কার বিল-২০২৩ পাস হয়েছে। আইন অনুযায়ী কৃষি জমির মালিকানা কোনো ব্যক্তির নামে ৬০ বিঘার বেশি জমি থাকলে সরকার অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। বিলে এও বলা হয়, ৬০ বিঘার বেশি কৃষি ভূমির মালিক বা তার পরিবার হস্তান্তর, উত্তরাধিকার, দান বা অন্য কোনো উপায়ে নতুন কোনো কৃষি ভূমি অর্জন করতে পারবে না। আইনবিদরা এও  বলেন, বিলটি যখন পাস হয় তখন তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার প্রক্রিয়ায় বলেন, যদি একজন ব্যক্তির ৬০ বিঘার বেশি জমি থাকে (বিঘা প্রতি ৩৩ শতক), তাহলে সরকার অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। এ বিষয়ে জেষ্ঠ্য আইনজীবী এডভোকেট জেডআই খান পান্না মানবজমিনকে বলেন, দুদকের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা নিউজে দেখতে পেয়েছি সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের স্ত্রীর কব্জায় ৫২১ বিঘা জমি। এর মধ্যে বেশির ভাগই কৃষি জমি। আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তির নামে ৬০ বিঘা জমি ক্রয় করতে পারেন, এর বেশি নয়। এক্ষেত্রে বেনজীরের স্ত্রীর নামে এই সীমা কয়েকগুণ অতিক্রম করেছে। আইন অনুযায়ী এসব জমি বৈধ টাকায় ক্রয় করলেও সরকার এগুলো খুব সহজেই অধিগ্রহণ করতে পারে। একমত প্রকাশ করে সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু মানবজমিনকে বলেন, আইন অনুযায়ী এক ব্যক্তির নামে ৬০ বিঘার বেশি কৃষি জমি রাখার কোনো বিধান নেই। আইন অনুযায়ী সাবেক পুলিশ প্রধানের স্ত্রী আইন লঙ্ঘন করে এত সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।  তিনি যদি এসব সম্পত্তি বৈধ টাকাতেও ক্রয় করেন, তারপরেও এসব সম্পত্তি সরকার নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে। কথা হয় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদের সঙ্গে। তিনি তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে মানবজমিনকে বলেন, এক ব্যক্তির নামে ৬০ বিঘার অতিরিক্ত জমি ছিল। দীর্ঘদিন বিচারকার্য চলার পর আদালত ওই ব্যক্তির নামে থাকা অতিরিক্ত জমি হস্তান্তরের নিদেশ দেন। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তির নামে কোনোক্রমেই শত শত বিঘা জমি থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে দ্রুত এই আইন যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য তিনি আহ্বান জানান।        

আদালত সূত্র জানায়, ১ম দফা ২৩শে মে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা প্রায় ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন। ২য় দফা ২৬শে মে স্ত্রী জীশান মির্জার নামে পাওয়া আরও ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি, বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও এক মেয়ের নামে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট খুঁজে পেয়েছে দুদক। ফ্ল্যাটগুলোর আয়তন মোট ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট। এই চার ফ্ল্যাট কেনা হয়েছিল একদিনে (২০২৩ সালের ৫ই মার্চ) বেনজীর আহমেদ অবসরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে। দাম দেখানো হয়েছিল মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। গুলশানে  খুঁজে পাওয়া চারটি ফ্ল্যাটের তিনটি তার স্ত্রীর নামে। একটি ছোট মেয়ের নামে (আদালতে করা দুদকের আবেদন অনুযায়ী তিনি তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন)। দু’টি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৩৫৩ বর্গফুট, দাম ৫৬ লাখ টাকা করে। বাকি দুই ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ২৪৩ বর্গফুট করে, দাম সাড়ে ৫৩ লাখ টাকা করে। জমি ও ফ্ল্যাট ছাড়াও দুদক বেনজীর আহমেদ ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র খুঁজে পেয়েছে। গত রোববার আদালতে দুদকের পক্ষে লিখিতভাবে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও জব্দের আবেদন করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংস্থাটির উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলাম। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের নামে থাকা এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) ও অবরুদ্ধের আদেশ দেন ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন।

নতুন করে যে ২৭৬ বিঘা জমি পাওয়া গেছে, তার পুরোটাই বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে। জমিগুলো মাদারীপুরের সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায়। ২০২১ ও ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় ১১৩টি দলিলে এসব জমি কেনা হয়। দলিলমূল্য দেখানো হয় মোট ১০ কোটি ২২ লাখ টাকা। ফলে প্রতি শতাংশের দাম পড়েছে গড়ে সাড়ে ১১ হাজার টাকার মতো। বিঘা পড়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এর আগে খোঁজ পাওয়া ৩৪৫ বিঘা জমির দলিলমূল্য দেখানো হয়েছিল ১৬ কোটি ১৫ টাকার কিছু বেশি। বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ই এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, তার স্ত্রীর নামে মাদারীপুরে জমিগুলো কেনা হয় তিনি আইজিপি থাকার সময়।

বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের শতভাগ মালিকানায় থাকা সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা ইকো রিসোর্ট ও একটি শিশির বিন্দু নামের প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আরও ১৫টি প্রতিষ্ঠানে থাকা বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের শেয়ার জব্দের আদেশও দেয়া হয়েছে। ওই ১৫টি প্রতিষ্ঠান হলো- নর্থ চিকস রংপুর, নর্দার্ন বিজনেস এসোসিয়েট, সেন্ট পিটার্স স্কুল অব লন্ডন, স্টিলথ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলা-টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি, ডেল্টা আর্টিসান, ইস্ট ভ্যালি ডেইরি, গ্রীন মাল্টিমিডিয়া, কমিউনিটি ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট, সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ল’ এনফোর্সমেন্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন, পুলিশ ট্রাস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট, পুলিশ ট্রাস্ট সার্ভিস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট, পুলিশ ট্রাস্ট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ নামের প্রতিষ্ঠানে।

এদিকে আদালতের আদেশের পর পুঁজিবাজারের ইলেকট্রনিক্স শেয়ার সংরক্ষণাগার সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, বড় মেয়ে এবং ছোট মেয়ের নামে সকল বিও অ্যাকাউন্ট বা হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) রাখতে নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সোমবার এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বিএসইসি থেকে পাঠানো হয়েছে বলে সিডিবিএল ও দুদক সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি দুদককেও অবহিত করা হয়েছে। এর ফলে অবরুদ্ধকরণ আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় অর্থ অবরুদ্ধ অ্যাকাউন্টগুলোতে জমা করা যাবে না বা কোনো অবস্থাতেই উত্তোলন করা যাবে না। ড্রাগন সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বেনজীর আহমেদের বিও হিসাব রয়েছে। সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস লিমিটেড ও ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে তার স্ত্রী জীশান মির্জা, ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে তার বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর এবং ডাইনেস্টি সিকিউরিটিজ লিমিটেডে তার ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিও হিসাব রয়েছে। বিও হিসাব অবরুদ্ধকরণ প্রসঙ্গে বিএসইসি’র নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কোর্টের সংশ্লিষ্ট আদেশের প্রেক্ষিতে ৫টি ব্রোকারেজ হাউজে ৬টি বিও হিসাব পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হলো। আদালতের আদেশ মোতাবেক উক্ত হিসাবগুলোর ওপর অবরুদ্ধকরণ আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় অর্থ উত্তোলন করা যাবে না। বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের স্থাবর সম্পদ জব্দ ও ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ কার্যকর করা শুরু হয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা জমি যাতে হস্তান্তর না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার সাব-রেজিস্ট্রার বরাবর আদালতের জব্দের আদেশ পাঠানো হয়েছে। ব্যাংক হিসাবের অর্থ যাতে হস্তান্তর বা রূপান্তর না হয়, সে জন্য আদালতের আদেশ পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেও।  এর আগে বেনজীর আহমেদের জব্দ ও অবরুদ্ধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি, হস্তান্তর বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আদালতের আদেশের কপি ও চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত সোমবার দুদকের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ের বিশেষ অনুসন্ধান টিম আদেশের কপি পাঠায়। সূত্র জানায়, বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামের জব্দ জমি বিক্রি, হস্তান্তর বন্ধে আদালতের আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রার ও সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো হয়েছে। জমি অন্য কারোর নামে যাতে নামজারি না করা হয় সেজন্য আদালতের রায়ের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়।

Tags:
No items found.

...

Get Our Monthly Newsletter, Directly Into Your Inbox!

Thank you! Your submission has been received!
Oops! Something went wrong while submitting the form